স্বরূপের সাথে ওর স্ত্রীর রোজই ঝগড়া হত। পাড়াপ্রতিবেশীদের বাচ্চাকাচ্চারা সবাই অ-আ-ক-খ লিখতে শিখে গেছে, অথচ স্বরূপের ছেলে রূপ কিছুই শেখেনি। এমনকী স্বরূপ ওর ছেলের হাতে খড়ি অবধি করতে দেয়নি। স্ত্রী প্রায়ই অভিযোগ করত, "কি গো বাচ্চাটাকে অশিক্ষিত বানিয়ে রাখতে চাও নাকি? ওদিকে নন্দবাড়ির বাচ্চাটাকে দেখো, এখন যোগ বিয়োগ করতে শিখে গেছে।" স্বরূপ কোনো উত্তর দিতনা, গম্ভীর মুখে খবরের কাগজে মুখ গুঁজে রাখত। স্ত্রী একপ্রকার জোর করেই একজন প্রাইভেট টিউটরকে জোগাড় করে এনেছিল, কিন্তু স্বরূপ তাকে ভাগিয়ে দেয়। স্বরূপের মা বাবাও বুঝতনা ছেলের এমন আচরণের কারণ। স্বরূপ নিজে উচ্চ শিক্ষিত, ফিজিক্সে পিএইচডি করেছে, অথচ নিজের ছেলে রূপের বেলায় এমন অবহেলা স্বাভাবিকভাবেই সবাইকে আশ্চর্য করত। রূপের বয়স পাঁচ। সে এখনও অ-আ-ক-খ লিখতে শেখেনি, পড়তেও শেখেনি। স্বরূপ যখন মোটামোটা রবীন্দ্র রচনাবলী নিয়ে বসত, তখন ছোট্ট রূপ বইয়ের দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকত। স্বরূপ মুচকি হেসে ছেলেকে বলত, “এসব বড়দের বই, ছোটদের পড়ার জিনিস নয়।” বাবা যখন অন্য ঘরে থাকত, ছোট্ট রূপ মাঝেমাঝে বাবার বইগুলো খুলে দেখার চেষ্টা করত। স্বরূপ দেখতে পেলে গম্ভীর মুখে বইটা কেড়ে নিত।
মাসখানেক বাদে স্বরূপ কিছু বাংলা আর ইংরেজীর ফার্স্ট বুক কিনে ঘরে রাখল। স্ত্রীর ভীষণ উৎসাহ, এবার ছেলে অক্ষর চিনবে, সংখ্যা চিনবে। নন্দবাড়ির বাচ্চার সাথে রূপ কম্পিটিশন দেবে। কিন্তু স্বরূপ কড়াভাবে বউকে বারণ করে দিল, রূপকে যেন ভুলেও হাতেখড়ি করানো না হয়। বইগুলো ঘরেই রাখা থাকত, রূপ বইগুলো নিয়ে পরম বিস্ময়ে ঘাঁটাঘাঁটি করত। অজগর সাপ কিংবা আমের ছবির পাশে কি লেখা রয়েছে, তার এক বর্ণও উদ্ধার করতে পারতনা। সেজন্য রূপের বিস্ময় আরও বাড়ত। সারাদিন বইগুলো নিয়ে পড়ে থাকত আর অক্ষরগুলোর মর্মোৎঘাটনের প্রচেষ্টা করত। একদিন বাবার ড্রয়ার থেকে পেনসিল বের করে নিজে নিজেই অক্ষরগুলো লেখার চেষ্টা করল। বইয়ের ছবিগুলোর পাশেই। অফিস থেকে ঘরে ফিরে স্বরূপ বইটা একবার খুলেই বিস্মিত হয়ে গেল। রূপকে জিজ্ঞেস করল, ‘এগুলো কিভাবে লিখলি? মা শিখিয়েছে?” রূপ চোখদুটো নীচু করে উত্তর দিল, “না বাবা আমি লিখেছি। এগুলো কি? আমায় শেখাবে?” স্বরূপ ছেলের মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিয়ে পাশে বসল। সহজ ভাষায় ব্যখ্যা করল, কিভাবে এই অক্ষরগুলোর মাধ্যমে বর্ণ তৈরি হয়। কিভাবে অক্ষরগুলোর মাধ্যমে আমরা মুখে উচ্চারণ করা কথাগুলো কাগজ পেনসিলে ফুটিয়ে তুলি। রূপের হাতে হাত মিলিয়ে কাগজে ফুটিয়ে তুলল অ-আ-ই-ঈ। রূপ পরম বিস্ময়ে শিখতে লাগল। যেগুলো এতদিন মনেপ্রাণে লিখতে চাইত, সেগুলো আজ বাবার হাতে হাত রেখে শিখছে। পেছনের দেওয়ালে মা সরস্বতীর ছবি, আজ বাবা আর ছেলের অকাল হাতেখড়ির সাক্ষী থাকলেন স্বয়ং দেবীও।
রূপ একটু বেশি বয়সেই স্কুলে ভর্তি হল। ফাইনাল পরীক্ষায় রূপ ফার্স্ট, বাকী বাচ্চাদের থেকে অনেক বেশি নাম্বার পেয়ে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ হল। বাকী বাচ্চাদের গার্জিয়ানরা আলোচনা করতে লাগল, “বেশি বয়সে ধেড়ে বাচ্চাকে ভর্তি করিয়েছে, ফার্স্ট তো হবেই।” স্বরূপের কানেও এসব কথাবার্তা আসত, সেগুলো শুনে স্বরূপ মুচকি হাসত।
একদিন নন্দদের ছেলের জন্মদিন ছিল, সপরিবারে স্বরূপ সেই আতিথ্য গ্রহণ করল। নৈশভোজের পরে নন্দগিন্নি আড়ালে স্বরূপকে জিজ্ঞেস করল, “আপনার ছেলে কদিন আগে অ-আ-ক-খ অবধি লিখতে পারতনা, এখন স্কুলে ফার্স্ট হচ্ছে কিভাবে বলুন তো? শুনতে পাই সারাক্ষণ নাকি বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকে। আমাদের ছেলেটাকে তো পিটিয়ে পিটিয়েও পড়তে বসাতে পারিনা। সুযোগ পেলেই স্মার্টফোনে গেম খেলা শুরু করে।”
স্বরূপ মুচকি হাসল। বলল, “একটা বাচ্চা জন্মের পরে বোঝেনা কোনটা স্মার্টফোন আর কোনটা পড়ার বই। তাও সে স্মার্টফোনের দিকে আগ্রহবোধ করে কিন্তু পড়ার বই দেখলেই পালিয়ে যায় কেন জানেন?” নন্দগিন্নি চুপ রইলেন। স্বরূপ বলল, “আপনার ছেলে পড়তে না বসলে আপনি তাকে মারেন। অর্থাৎ পড়াশোনা ওর কাছে এখন ভয়ের জিনিস। ও জানে পড়া মুখস্ত করতে না পারলে মার খেতে হবে, বেশি নম্বর না পেলে বকুনি খেতে হবে। এমনকী বেশিরভাগ বাচ্চা এটাও জানেনা, তাদেরকে কেন জোর করে অ-আ-ক-খ মুখস্ত করানো হয়। সবাই করছে বলে ওরাও করে। মা বাবার বকুনি কিংবা মারের ভয়ে মুখস্ত করে। অথচ বাচ্চারা স্মার্টফোনের দিকে আগ্রহবোধ করে কারণ সেটা ঘাঁটতে আপনারা নিষেধ করেন। নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আকর্ষণ, প্রতিটা মানুষ এমনকী প্রাণীর ভেতরেও জন্মগতভাবে থাকে। আপনি আপনার ছেলেকে স্মার্টফোন ঘাঁটতে বাধা দেন, আমি আমার রূপকে বই পড়তে বাধা দিতাম। ফলাফলটা আপনার চোখের সামনে।"
নন্দগিন্নি খানিক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু বই পড়তেই রূপ আগ্রহ দেখাল কেন?” স্বরূপ বলল, “কারণ আমি ওর সামনে মোটামোটা বই পড়তাম। বাচ্চারা বড়দের অনুকরণ করতে চায়। সেটায় বাধা দিলে ওদের আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। ঠিক যেমন আপনার ছেলে, আপনাকে আর নন্দদাকে দিবারাত্র স্মার্টফোন ঘাঁটতে দেখে। সেইজন্য ওরও আগ্রহ স্মার্টফোনের দিকেই।” ঘোষগিন্নি তবুও মন থেকে মানতে পারছিলেন না। আরও খানিক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু আপনার এই থিওরির ওপর ভিত্তি করে এত বড় রিস্ক নিলেন? রূপ নিজে থেকে আগ্রহ না দেখালে তো সারাজীবন অশিক্ষিতই থেকে যেত।”
স্বরূপ আবার মুচকি হেসে উত্তর দিল, “কেউ সারাজীবন অশিক্ষিত থাকেনা। শুধু আপনারাই শিক্ষা শব্দটাকে সঠিকভাবে বিশেষায়িত করতে শিখলেন না। আমি বাড়িতে রূপের জন্য ব্যাট, হকি স্টিক, ফুটবল, হারমোনিয়াম, আঁকার খাতা সবকিছু কিনে রেখেছিলাম। কোনো একটা জিনিসের প্রতি আগ্রহ দেখাত এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকুন। যদি ব্যাটের দিকে ওর আগ্রহ থাকত, তাহলে বড় হয়ে ক্রিকেটার হত। হারমোনিয়ামে উৎসাহ পেলে গায়ক হত। আপনারা শিক্ষা বলতে শুধু বই-খাতা বোঝেন, কিন্তু শিক্ষার সংজ্ঞাটা একটু আলাদা। রূপ বড় হয়ে কি হবে, এটা ওর সিদ্ধান্ত। আমি শুধু ওকে শিখিয়েছি, কিভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।”
এত সাংঘাতিক থিওরি নন্দগিন্নির পক্ষে হজম করা শক্ত ছিল। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু রূপ যদি স্মার্টফোনের দিকে আগ্রহ দেখাত?” স্বরূপ বলল, “স্মার্টফোন কি খারাপ জিনিস? আই-ফোনের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের রোজগার কত জানেন? যদি রূপের উৎসাহ স্মার্টফোনের দিকেই থাকত, তাহলে ওকে শেখাতাম টেকনোলজির ব্যাপারে। হয়ত রূপ বড় হয়ে এমন এক ভারতীয় স্মার্টফোন কোম্পানির প্রতিষ্ঠা করত, যেটা হয়ত অ্যাপেলকেও টেক্কা দিত। আশা করি আর কোনো প্রশ্ন নেই, চলি দিদি। আজকের রান্নাটা দারুণ ছিল। ধন্যবাদ।”
বছর পনেরো পেরিয়ে গেছে। রূপ এখন আইআইটি খড়গপুরে পড়ছে। মাসখানেক আগে ইসরোর তরফ থেকে চিঠি পেয়েছিল, স্পেস সংক্রান্ত ওর একটা প্রোজেক্ট সায়েন্টিস্টদের পছন্দ হয়েছে, তাই একসাথে রিসার্চ করতে চায়। স্বরূপ রিটায়ার করে স্ত্রীর সাথে সুন্দর সময় কাটাচ্ছে। পড়াশোনার যে নেশা স্বরূপের মধ্যে দিয়ে তার ছেলের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল, সেই নেশা একদিন দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে বলেই সে আশাবাদী।
Collected...